Friday, October 17, 2025

সর্বাধিক পঠিত

আরও পড়ুন

বিএনপির তোপ: পিআর গণভোটের দায়িত্ব কার হাতে?

ঢাকা, ১১ অক্টোবর ২০২৫: বাংলাদেশের রাজনৈতিক মহলে প্রপোর্শনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) ভোটার প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতি নিয়ে তীব্র বিতর্কের সূত্রপাত হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী স্পষ্ট করে বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে এই পদ্ধতি চালু করার জন্য গণভোট আয়োজনের কোনো আইনি বা জনপ্রিয় ম্যান্ডেট দেওয়া হয়নি। এই মন্তব্য এসেছে একটি গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা সভায়, যেখানে নির্বাচনী সংস্কারের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশেষজ্ঞরা মতামত রাখেন।

কসমস গ্রুপ এবং ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশ (ইউএনবি)-এর যৌথ আয়োজনে শনিবার দুপুরে রাজধানীর মৌচাকের কসমস সেন্টারে অনুষ্ঠিত ‘ইলেকশন ২০২৬: এ ক্রিটিকাল লুক অ্যাট প্রোপোর্শনাল রিপ্রেজেন্টেশন’ শিরোনামের সেমিনারে এই বিষয়টি প্রধান আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠে। সভায় বক্তারা পিআর পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেন, যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে নতুন দিক থেকে দেখার সুযোগ করে তোলে।

আমীর খসরু তাঁর বক্তব্যে জোর দিয়ে বলেন, “প্রপোর্শনাল রিপ্রেজেন্টেশন চালু করার জন্য কেন আমাদের গণভোটে যেতে হবে? রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এখনও ঐক্যমত্য গড়ে ওঠেনি। যদি এই পদ্ধতি নিয়ে গণভোটের প্রয়োজন হয়, তাহলে আগামী দুই বছরে সব ইস্যুতে গণভোট করতে হবে। প্রশ্ন হলো, এই দায়িত্ব কে আমাদেরকে দিয়েছে? জনগণ তো রাজনৈতিক দলগুলোকে গণভোটের ভার দেননি।”

তিনি আরও যোগ করেন, বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধানের ভিত্তিতে গঠিত হয়েছে এবং চলছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরে আসতে হলে সংবিধানের কাঠামোর মধ্যেই নির্বাচন আয়োজন করতে হবে। “নির্বাচিত সরকার এবং সংসদ গঠনের পরই জনমত সংগ্রহ, আলোচনা এবং প্রয়োজনীয় সংশোধনের সুযোগ তৈরি হবে,” খসরু বলেন।

তাঁর মতে, বর্তমানে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক অর্ডার থেকে বিচ্যুত অবস্থায় রয়েছে। গত ১৪ মাস ধরে একটি অ-নির্বাচিত সরকার চলছে, তাই প্রথমে নির্বাচিত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা জরুরি। “পরে প্রত্যেক দল তাদের নিজস্ব বিষয় নিয়ে জনগণের কাছে যাবে। গণতন্ত্র তো একটি চলমান সংলাপের প্রক্রিয়া—ডেমোক্রেসি ইজ এ কনভারসেশন প্রসেস,” তিনি উল্লেখ করেন।

সভায় বিএনপির আরেকজন স্থায়ী কমিটির সদস্য আবদুল মঈন খান পিআর পদ্ধতির সমালোচনা করে বলেন, এটি শুধু দলীয় আসন বাড়ানোর জন্য কার্যকর, কিন্তু জনগণের মৌলিক সুবিধা দেয় না। “আমি কেন পিআর চাইব? শুধু পার্লামেন্টে অতিরিক্ত আসন পাওয়ার লোভে? এতে মানুষের প্রকৃত চাহিদা উপেক্ষিত হয়, যা গণতন্ত্রের চেতনার সাথে সাংঘর্ষিক,” খান বলেন।

তিনি যোগ করেন, পিআর মানে দলকে আরও শক্তিশালী করে ব্যক্তিগত প্রতিনিধিকে দুর্বল করা। “জনগণ দলকে ভোট দেবে, দলই প্রার্থী নির্ধারণ করবে। এতে সরাসরি জবাবদিহিতা কমে যায় এবং ব্যক্তিগত প্রতিনিধির দুর্বলতা গণতন্ত্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।” বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে যখনই কোনো দল অতিরিক্ত প্রভাবশালী হয়েছে, তখন জনগণের জন্য সংকট দেখা দিয়েছে—পিআর এই ঝুঁকি আরও বাড়াতে পারে, খানের মতামত।

নাগরিক ঐক্যের নেতা মাহমুদুর রহমান মান্নার বক্তব্য উল্লেখ করে আমীর খসরু বলেন, জনগণ পিআর সম্পর্কে খুব কম জানে। পিআর-পন্থী দলগুলোকে নির্বাচনী ইশতেহারে এটি তুলে ধরে জনমত নিতে হবে। জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনে যে ঐক্যমত্য গড়ে উঠেছে, তা নিয়ে এগোনো যায়, কিন্তু বাকি বিষয়ে জনগণের ম্যান্ডেট অপরিহার্য।

তিনি প্রশ্ন তুলে বলেন, “বাংলাদেশের জনগণ কি ২০-৩০টি রাজনৈতিক দলকে দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণের দায়িত্ব দিয়েছে? জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন বা দলগুলোকে এমন কোনো অধিকার দেওয়া হয়নি। গণতন্ত্র সংলাপ এবং আলোচনার চলমান প্রক্রিয়া, তাই কমিশন সবকিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারে না—যতটুকু ঐক্যমত্য আছে, তা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে এবং বাকিটা জনগণের কাছে নিতে হবে।”

কসমস গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এনায়েতুল্লাহ খানের সভাপতিত্বাধীন এই অনুষ্ঠানে অন্যান্য বক্তা হিসেবে অংশ নেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ, এবি পার্টির মজিবুর রহমান মঞ্জু, গণসংহতি আন্দোলনের আবুল হাসান রুবেল, গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান এবং নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব সম জকরিয়া।

সভার মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মামুন আল মোস্তফা, যিনি পিআর পদ্ধতির তাত্ত্বিক দিক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেন। এই আলোচনা বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সংস্কারের গুরুত্ব তুলে ধরে, যা রাজনৈতিক দল এবং নাগরিকদের জন্য চিন্তার খোরাক যোগাবে।

সাম্প্রতিক